অচেনা মুখোশের ভীড়ে
___________________
“আচ্ছা ঝকমারি! শখ বলে কি এই ধাপধারা গোবিন্দপুরেই পিকনিক করতে হবে না কি?” শীতকালের গ্রামের কাঁচা রাস্তায় সাইকেল রিকশার ঝাঁকুনিতে অস্থির হয়ে নিজের মনেই গজগজ করছিলাম, আর সুব্রতকে আশ মিটিয়ে গাল দিচ্ছিলাম! ব্যাটা থাকে কোথায় কেনিয়ায়। জঙ্গল দেখে দেখে এতদিনে তার আশ মিটে যাওয়ার কথা। সে কিনা কদিন ধরে নাছোড়বান্দা, “ভাই, দশবছর পর দেশে আসছি! ছেলেবউকে একটু গ্রামবাংলার দর্শন করাবো না বল্?” ওর উৎসাহের আতিশয্য যথারীতি সংক্রামিত হয়েছে আমাদের কজনের ছোট্ট বন্ধুমহলে। আর পড়বি তো পড়, যেহেতু অদ্যাবধি ব্যাচেলর, আর ডাক্তারী করি এই জেলারই হাসপাতালে, তাই আমার উপরেই দায়িত্ব বর্তেছে পিকনিকের জায়গায় গিয়ে আগে থেকে সব দেখেশুনে আসার! আসলে, স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। আর মুখের উপর না বলতেও জানতে হয়, না হলে আমার মত ভুগতে হয় বৈকি!
যাই হোক, কয়েকটা ছুটি পাওনা ছিল এমনিতেও। রোগী আর হাসপাতাল, এই করে বেশ হাঁপিয়ে উঠছিলাম। একটু বাইরের হাওয়া খাওয়াও হবে চিন্তা করে আমার ছোট ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়েই পড়লাম এক সকালবেলা। সুব্রত অবশ্য একটা স্পটের ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছিল আগেই। কিছুটা আন্দাজে, আর বেশ কিছুটা একে ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে চলতে লাগলাম। খান দুয়েক ট্রেন বদলে, রিকশায় কোমরের হাড়গোড় মোটামুটি নড়বড়ে করে, বহু কসরতের পর অবশেষে পৌঁছনো গেল নদীর ধারের নির্জন এক জমিদারবাড়ীতে। এটাই নাকি একেবারে আইডিয়াল গ্রামবাংলার থিম, সুব্রতর বিদেশিনী বৌ আর পুত্রের জন্য। যখন পৌঁছোলাম, ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। টিমটিম করে পঞ্চায়েতের রাস্তায় দু একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বললেও সেগুলো যে কতখানি আলো দিচ্ছে, আর কতটা অন্ধকারকে ডাকছে ঠিক বোঝি মুশকিল। ভাড়া মেটাবার সময় রিকশাওয়ালার মুখের দিকে তাকাতে কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগলো হঠাৎ! স্টেশনের কাছ থেকে ওঠার সময় যদ্দুর মনে পড়ছে একটা জোয়ান মদ্দ লোকের রিকশায় উঠেছিলাম। এতো দেখছি এখন ষাট বাষট্টি বছরের কোনো বয়স্ক রিকশাওয়ালার মুখ! দাঁতগুলো বের করে সাগ্রহে হাতটা বাড়িয়ে আছে। একটু অপ্রস্তুত লাগলেও ব্যাপারটা মনের ভুলই ভেবে তাকে ছেড়ে দিয়ে প্রায়ান্ধাকার বাড়ীটার দিকে এগোতে পিছন থেকে রিকশাওয়ালার হাঁড়ির মত গলা এল:
– বাবু কি এথায় থাকচেন আতে (রাতে)?
ঘাড় ঘোরাতে দেখি সে ইতিমধ্যে গলার মাফলারটা গোটা মাথায় মুখে এমনভাবে জড়িয়েছে, যে আধা অন্ধকারে তার মুখই দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। জবাব দিলাম:
– “না না, কথা বলে ফিরে যাবো! কেন, রিকশা পাবো না?
– আজ্ঞে, তা পাবান নে বোদয়। হেথায় আতের দিকে কেউ আসতে টাসতে চায় নে তো তেমনি!
– তাহলে? এতটা হেঁটে যেতে হবে? অনেকটা রাস্তা তো ভাই!
– আপুনি বললে ঘট্টা (ঘন্টা) খানেক হেথায় দেঁড়াই?
– ও বাবা, তাহলে তো খুব ভালো হয়। তুমি ভাই দাঁড়াও বুঝলে, আমি এই আধঘন্টার মধ্যেই আসছি! কথা বলেই!
– আসুন আজ্ঞে। মু দেঁড়াই।”
যাক্, একটা বড় ঝামেলা মিটলো। প্রথমে না ভাবলেও নামার পর দুশ্চিন্তা হচ্ছিল এই অন্ধকারে স্টেশনে নিরাপদে ফেরৎ যেতে পারব তো সময়ে? রিকশাওয়ালাটাকে বেশ ভালোই মনে হল। যাইহোক, এসেই যখন পড়েছি, তখন বাড়ীর মালিকের সাথে একটুখানি কথা বলেই তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে! চুলোয় যাক গ্রামবাংলার শোভা, সুব্রতকে জানিয়ে দেবো লোকেশন পছন্দ হয়নি। এই নির্জনে সাধ করে আসে কেউ? রামোঃ। মাথায় থাক আমার পিকনিক। আর কি বিশ্রী ধুলো রে বাবা!
আধভাঙা সিংহদরজাটার একদিকের পাল্লাটা সরিয়ে ভিতরে ঢুকতে বেশ ঠান্ডা লাগলো হঠাৎ। সঙ্গে টর্চ ছিল। আলোটা ফেলতে একটা ছোট বাগান, বা বলা ভালো জঙ্গুলে কিছু ঝোপঝাড় দেখতে পেলাম। সেগুলো পেরিয়ে আরো এগোতে দেখি বাড়ীর সদর দরজা পুরোটা হাট করে খোলা। ভিতরে আবছা একটা আলোর আভাস মতও যেন দেখা যাচ্ছে বোধ হল। তারপরই দেখি চাদর মুড়ি দিয়ে একট, ছোকরামত লোক ছোট একটা হ্যারিকেন লন্ঠন হাতে আমার দিকেই হেঁটে আসছে। সে কাছে আসতে তাকে প্রশ্ন করলাম:
– “এ বাড়ীটা ভাড়া দেওয়া হয় শুনলাম, ঐ পিকনিক টিকনিকের জন্য আর কি। এখন কথা বলা যাবে তো? অনেকদূর থেকে আসছি!
– কিসের জন্যি কইলেন? ভাড়া নিবেন?
– পিকনিক…মানে, মানে… আমরা ঐ ইয়ে বনভোজন করব..
– অ, মালিক থে দেখা করবেন? আসেন।”
কথাটা বলেই লোকটা, খেলনা পুতুল যেমন ঘোরে, ঠিক সেইভাবে উল্টোদিকে ঘুরে লন্ঠনটা হাতে নিয়ে চলা শুরু করল। কি আর করি, আমাকেও তার পিছু নিতে হল অগত্যা। বেশ দ্রুতই হাঁটছিল সে। সত্যি বলতে বিনা কারণে এত জোরে হাঁটার অভ্যাস সত্যিই আমাদের নেই। লোকটার সঙ্গে তাল রেখে চলতে তাই বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল। আর কি দীর্ঘ এই পথচলা! মনে হচ্ছিল যেন ধূসর অন্ধকারের মধ্যে পরের পর মহল, পেরোচ্ছি তো পেরোচ্ছিই। আমার সঙ্গীর হাতে ধরা ঐটুকু লন্ঠনের মৃদু আলো ব্যতীত এতবড় প্রাসাদের কোথাও এতটুকুও আলো দেখতে পেলাম না। আর সেইরকমই চাপা নৈঃশব্দ। দুএকবার চেষ্টা করলাম লোকটাকে জিজ্ঞাসা করতে, যে এতবড় বাড়ীতে ইলেকট্রিসিটি আছে, কি না! কিন্তু মনে হল সে যেন ইচ্ছে করেই আমার কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করল। ঘন অন্ধকারে বাড়ীটার তেমন কিছু দৃষ্টিগোচর না হলেও শুধু এটুকু বারবার মনে হচ্ছিল, যে এই ভগ্নপ্রায়, ধূলিধূসরিত বিপুলায়তন অট্টালিকা খুচরো কোনো পিকনিকের জন্য তো নয়ই, বরঞ্চ যেকোনো বিগ বাজেটের হরর মুভির আউটডোর লোকেশন হিসাবে আদর্শ !!
বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে/হোঁচট খেয়ে শেষমেশ আমরা বাড়ীটার এমন একটা অংশে এসে পড়লাম যেটা নদীটার একদম মুখোমুখি অবস্থান করে। লম্বা লম্বা পাথরের থামওয়ালা একটা টানা বারান্দা দিয়ে তখন আমরা হাঁটছিলাম। সারাদিনের মধ্যে এই প্রথমবার আমার মনটা সত্যিকারের ভালো লাগলো। বস্তুত এতক্ষণের দীর্ঘ ও বিরক্তিকর জার্নির ক্লান্তিতে এবং ধুলো আর অন্ধকারের সহাবস্থানের জেরে বাড়ীটার উপর আমার যে তীব্র বীতরাগ জন্মাচ্ছিলো, শীতের আমেজে ও নদীর হাওয়ায়, সাথে বিরাট জলবক্ষের আবছায়া দৃশ্যপট নজরে আসাতে সেটা যেন অনেকটাই কেটে গেল। “নাঃ, এখানে পিকনিক করলে তেমন মন্দ হবে না” নিজের মনেই বললাম।
ওই যাঃ, আমার সঙ্গী আবার কোথায় গেল? এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে হাঁফ ছেড়েছি, আর দেখ কান্ড! তাকে ডাকতেই যাচ্ছিলাম, এমন সময় ঠিক কানের কাছেই আচমকা “চলেন” শুনে আঁতকে উঠেছি। অবাক হয়ে দেখি, অবিকল সেই রকম মুড়িশুড়ি দেওয়া, হ্যারিকেন হাতে লোকটা….কিন্তু হলফ করে বলতে পারি এতক্ষণ এর সঙ্গে আমি আসি নি! এও যে বয়স্ক কোনো লোক! চোখ কচলে তার দিকে আবার তাকিয়ে দেখলাম সেও যেন বেশ মজা পেয়ে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমতা আমতা করে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম:
– “সে কোথায় গেল ভাই?
– কে বাবু?
– যার সাথে এতক্ষণ আসছিলাম?
– আমার সঙ্গেই তো আলেন বাবু!
– কি বলছো? তুমি তো বুড়ো মানুষ। সে তো একটা রোগাপাতলা লোক ছিল!!
– মু ছাড়া এবাইতে (বাড়ীতে) আর কেউ কাজের জন নাই বাবু। আসেন, মালিক অপেক্ষা করেন।”
আমাকে বিস্ময় প্রকাশ করবার আর এতটুকুও সুযোগ না দিয়ে সে আগের লোকটার মতই আলোটা হাতে ঝুলিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিল। সত্যি বলতে আমার তখন রীতিমতো গা ছমছম করছিল, কোন বিপদ অবশ্যম্ভাবী মনে হলে যেমন হয়। একবার ভাবলামও, কাজ নেই আর এগিয়ে। রিকশাটা যখন এখনও অপেক্ষাই করছে, তখন ফিরেই যাই না কেন ভালোয় ভালোয়। কিন্তু কর্তব্য বড় দায়, আর তার থেকেও বড় অস্বস্তি লাগল নিজেকে কাপুরুষ ভাবতে। “কি এসব চিন্তা করছি এগুলো? মাথাটা কি খারাপ হয়ে গিয়েছে আচমকা? আঁধারে অন্ধকারে এরকম ভুল যেকোনো কারোরই হয়। কি দেখতে কি দেখেছি, ভাবছিও ভুলভাল। আসলে ফেরার চিন্তাটা আছে বলেই হয়ত” – নিজেকে স্বান্তনা দিতে দিতে আবার এগোলাম লোকটার পিছন পিছন।
এখন বাড়ীর মালিকের মুখোমুখি বসে আছি। এইমাত্র হল, আবার বেশ কিছুটা হাঁটিয়ে এবং হোঁচট খাইয়ে আমার লন্ঠনধারী পার্শ্বচর অবশেষে আমাকে ওনার ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে। ঘরে ঢুকতে ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি, বাকী বাড়ীটার তুলনায় এই ঘরটা অপূর্ব সব কারুকার্যমন্ডিত আসবাবপত্রে ভরা, এবং চারদিকের দেওয়াল ও ছাদের সাজসজ্জাও রীতিমতো যাকে বলে ‘রয়্যাল’ শ্রেনীর। মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম সেই জমিদারী যুগের একটুকরো ঝলক। লোকটা চলে যেতে আমি মালিকের দিকে চাইলাম, এবং কিমাশ্চর্য্যম!! আবার সেই চমক। প্রথম দেখায় আমি নমস্কার করাতে ভদ্রলোককে মনে হয়েছিল আমাদেরই বয়সী হবেন। এখন মাথার উপরের মাঝারী আকারের, কিন্তু বাহারী ঝাড়লন্ঠনটার নরম আলোতে দেখে ওনাকে খুব কম করেও সত্তর বছর বয়স্ক অন্য কেউ লাগছে। যাই হোক, আজ এটা এতটাই বেশী বার ঘটেছে, যে অনুভব করলাম আমার মস্তিষ্কও আপাতত বেশ মানিয়ে নিয়েছে। যেন দিনরাত্রি বা সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মত এটাও খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, তার বেশী কিছু নয়। একবার হাতের ঘড়িটার দিকে চোখ যেতে দেখলাম কাঁটাগুলো স্থির। যাক্, ভালদিনেই ব্যাটারীটাও গেল। তাড়াতাড়ি কথা সারতে হবে ভেবে কিছু বলার আগে ছোট্ট করে একবার গলা খাঁকড়ানি দিতেই দেখলাম বেশ হাসিহাসি মুখে ভদ্রলোক বলে উঠলেন:
– ” আপনি বনভোজনের জন্য ভাড়া নিতে চান?
– হ্যাঁ, শুনেছি আপনারা না কি ভাড়া দেন?
– কবে চান?
– সেটা এখনও ঠিকঠাক হয় নি অবশ্য। আসলে আমার এক বন্ধু দেশের বাইরে থাকে। সে আসছে কদিন বাদেই। তারপর….
– অঅ। ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই। পেয়ে যাবেন!
– ভাড়া কেমন? অ্যাডভান্স..মানে অগ্রিম কত দিতে হয় টয় একটু..?
– হবে, ওসব হবে। আপনি আসছেন কোথা থেকে?
– আমি এমনিতে এখন ইসলামবাজারে থাকি। আদতে কলকাতার লোক।
– কাজ করেন ওখানে?
– ওখানকার জেলা হাসপাতালে আছি।
– আপনি ডাক্তার?
– হ্যাঁ!
– আরে, আপনি তো গণমান্য ব্যক্তি। ছি ছি, চিনতেই পারি নি। কিছু মনে করবেন না মশাই।
– আপনি উতলা হবেন না। এতে তো মনে করবার মত কিছু নেই!
– আপনি কোন রোগ দেখেন ডাক্তার?
– আমি সাইকোলজিস্ট। মানে, মনের রোগের চিকিৎসা করি।
– মাথার ব্যামো? মানে পাগল? সারে?
– ঠিক তা নয়। মানে মনের অসুখ মানেই পাগল নাও হতে পারে..
– সারে কি??
– দেখুন, এভাবে তো বলা যায় না। অনেক পরীক্ষা করতে হয়, সাইকোথেরাপির বিভিন্ন ধাপ আছে। রোগীর সাথে কথা বলতে হয়। বাড়ীতে কারোর এরকম কিছু আছে কিনা সেই….”
কথাটা পুরোপুরি শেষ না করতে দিয়েই সে হঠাৎ করেই তার একহাত তুলে আমায় থামতে বলাতে চমকে গিয়েই থেমেছি। পরের একটানা পাঁচ ছয় মিনিট তার মুখে যা যা শুনলাম, তাতে দশবছরের উপর জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা করা, হাজার হাজার মানসিক রোগী দেখা ডাক্তারবাবুর সারা শরীরও আস্তে আস্তে হিম হয়ে এল। অদ্ভুত উত্তেজনায় ভরা তার দীর্ঘ বক্তব্য ছিল:
“দেখুন মশাই, বাড়ী ভাড়া বলুন, কি ডাক্তারী করা বলুন..মাথা ঠিক রাখতে পারলেই সব ঠিক। নইলে সবই বরবাদ। আমায় একবার দেখুন, অনেকে সন্দেহ করে আমার না কি মাথার ব্যামো আছে। জানি না কতটা সত্যি, কিন্তু টানা দেড়শো-দুশো বছর ধরে একই কথা সবার কাছে শুনলে কেমন অদ্ভুত লাগে না, বলুন? আজ আপনাকে পেয়েছি, এ আমার পরম সৌভাগ্য। অনেকদিন ধরে মনে হচ্ছিল নিজেকে একটু পরীক্ষা টরীক্ষা করিয়ে দেখলে কেমন হয়? কিন্তু সমস্যা হল যে, আমি আবার দিনের আলো টালো তেমন সহ্য করতে পারি না, তাই ঐ সময়টা অন্দরমহলেই কাটাই বেশীরভাগ। অভ্যাস হয়ে গেছে, অনেক যুগের ব্যাপার তো! এই ছোটখাট কাজকর্ম, লেখালেখি, লোকজনের সাথে কথাবার্তা সব রাতের দিকেই করি। তবে বিশেষ আসেটাসে না কেউ এখন আর। অনেকদিন বাদে যেমন আপনি এলেন আজ!!” অনেকক্ষণ বকে লোকটা পরপর দুবার বিরাট হাই তুলে থামল!
আমি ততক্ষণে নিজের আশুকর্তব্য স্থির করে ফেলেছি। চুলোয় যাক বন্ধুত্ব, বরবাদ হোক সুব্রত আর তার পরিবারের গ্রামবাংলা ভ্রমণের উটকো শখ! আমাকে তাড়াতাড়ি পালাতে হবে, এই বিপজ্জনক উন্মাদের কবল থেকে..যে করেই হোক..এখনই, এই মুহূর্তে! কিন্তু কি করে পালাব?? ও যে সটান বসে আছে দরজাটার ঠিক পাশেই!
লোকটা বোধহয় মানুষের মন পড়তে পারে। এসব ভাবতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। সামলে নিয়ে এক সেকেন্ডের জন্য চোখাচোখি হতে আগের মতই মোলায়েম গলায় লোকটা বলল:
– ” ও ডাক্তারবাবু! আপনি মিছেই ডরান। আপনার এক পয়সাও ভাড়া দিতে লাগবে না। যত খুশি পিকনিক না কি বনভোজন ওসব করেন!
– না, মানে..অন্য আরেকদিন আসব বুঝলেন! আজ উঠছি, কেমন? অনেকদূর ফিরতে হবে তো।
– যাবেন তো! আপনাকে আমার গরীবখানায় বরাবরের জন্য আটকে রাখতে থোড়াই পারব? তবে চিন্তা করেন না। রিকশাওয়ালাটা আছে এখনও, ঘন্টাখানেক হতে ঢের বাকী!!
– আ..আ..আপনি ক্কি কি করে জানলেন এসব..?? কেউ তো ছি..চ্ছিলো না?
– এটাই তো কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারি না ডাক্তার। সবাই ভাবে আমি একটা বদ্ধ পাগল। তুমি কি জান, আমার এই এত বড় বাড়ীর আশপাশের, বহুদূরের, সঅঅবকিছুর শব্দ আমার কানে বাজে সর্বক্ষণ!! সর্বক্ষণ! এখনও বাজছে! আমার দিন নাই, রাত নাই..যুগ যুগ ধরে ঘুম নাই..কিসের এ অভিশাপে কত বছর আমার চোখের পলক পড়ে নাই..আমায় বাঁচাও ডাক্তার! এ বাড়ী আমি তোমাকে দান করে দেবো..সব দিয়ে দেবো..বিশ্বাস কর..টাকা, গয়না, জমিজমা..সঅঅব, সব! শুধু আমায় একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও ডাক্তার..দয়া কর..আঃ আঃ, নাআআআ, আর পারছি নাআআ!!!!”
বলতে বলতে হঠাৎ দেখলাম লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগোতে এগোতে নিজেরই ঘাড়ের নীচে দুইহাত দিয়ে উন্মত্তের মত টানাটানি শুরু করেছে, যেন মুন্ডুটা উপড়েই ফেলতে চায়। এতক্ষণে আমার দৃষ্টিগোচর হলো তার হাতের বড়বড়, ভয়ঙ্কর নখগুলো..যেন দুঃস্বপ্নে দেখা কোনো ভয়াল পিশাচের হিংস্র, ধারালো নখর!!
আতঙ্কে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সন্মুখের ভয়াবহ দৃশ্যের চিত্রনাট্য যেন আমার কাছে নিঃসীম এক অভিশপ্ত রাতের অদৃষ্টপূর্ব পটভূমিকা উন্মোচিত করল। চোখের সামনে দেখলাম লোকটার ধারালো নখগুলো তার ঘাড়ের নীচের মাংসে বসে যাচ্ছে..তারপর ফিনকি দিয়ে রক্তের ধারা ছুটলো..তার মুন্ডুটা উপড়ে ছিটকে গেল একদিকে..দেখলাম ধীরে ধীরে তার বাকী শরীরের যাবতীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো এক এক করে খসে ঝরে ঝরে পড়ছে ঘরের মেঝেতে..একের পর এক..রক্তমাখা হাত, পা, উদর, মাংসপেশী, পঞ্জরাস্থি….সহসা বিষম পূতিগন্ধে ভরে গেল গোটা ঘর..উপর থেকে সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ল জ্বলন্ত ঝাড়লন্ঠনটা..একপলকে আগুন ধরে গেল লোকটার কবন্ধ দেহাবশেষে..মাংসপোড়া বীভৎস গন্ধে আমার নাড়ী উল্টে আসতে লাগল..মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম আমি একটা প্রায় ভেঙে পড়া, বয়সের ভারে জীর্ণ, বহুপুরাতন ঘরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি…
ভয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছলে শুনেছিলাম মানুষ না কি বাঁচার অন্তিম প্রচেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে..একটা আর্ত চিৎকার করে আমি সেই জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডটার পাশ কাটিয়ে লাফিয়ে বেরোলাম অভিশপ্ত ঘরটা থেকে। সঙ্গে আনা ব্যাগ, টর্চ সব পড়ে রইল সেখানে। অন্ধকারের মধ্যে ধাক্কা খেতে খেতে একটু আগে আসা পথের যেটুকু মনে ছিল, তাতেই পড়িমড়ি ছুটতে থাকলাম..যে করেই হোক, এই ভয়াবহ প্রেতপুরীর থেকে বেরোতেই হবে আমাকে…
নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল..তাও ছুটছিলাম প্রাণপনে.. অবশেষে চাঁদের হালকা আলোয় দেখতে পেলাম সেই ঝোপঝাড়ের জঙ্গল আর..সেটা পেরিয়েই সেই আধভাঙা সিংহদরজাটা..ঐ তো দেখা যাচ্ছে! হৃৎপিন্ড যেন এক্ষুনি থেমে যাবে এমন বোধ হচ্ছিলো..আর যেন ছুটতে পারছিলাম না..একটু, আর একটু..তারপরই জীবন..জ্যান্ত মানুষের পার্থিব জগৎ..একটুখানি জল পেলে বেঁচে যাই..দাঁড়াও..একটু, আর একটুখানি..!!
অবশেষে সেই সিংহদরজার বাইরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে রাস্তার ধুলোর উপরেই যে কখন হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছি তা আর খেয়াল নেই। ঘামে ধুলোয় মাখামাখি গোটা শরীর! বেশ কিছুক্ষণ বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসলাম। মনে এল এবার ফিরতে হবে, এই অভিশপ্ত জায়গাটায় আর একমুহূর্ত নয়। নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম প্রায় নিশ্চিত আতঙ্কের হাত থেকে বাঁচিয়ে পুনর্জন্ম ঘটাবার জন্য! ইতিউতি তাকিয়ে দেখি সেই ঢিমে ওয়াটের অস্পষ্ট বাল্বের আলোর নীচে মাফলার মুখে জড়িয়ে গাড়ীর উপর আমার রিকশাওয়ালাটা ঝিমোচ্ছে। আমি গিয়ে ডাকতে তন্দ্রা ভেঙে উঠে সে কিছুক্ষণ যেন আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চিনতেই পারল না। তারপর তার দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে হাই তুলে বলল:
– “বাবু, আপনে অনেক দেরী করে ফ্যাললেন আজ়। টেরেন বেইরে গেসে। আপনার আর গে কাজ় নাই!
গলার সুরটা যেন কিরকম! ভুরু কুঁচকে আমি কিছু বলবার আগেই দেখি সে তার লম্বা আঙুলটা তুলে আমার পিছনপানে ইশারা করছে। প্রথমে ঠিক বুঝি নি। পরে পিছনে ফিরতেই আচম্বিতে শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে গেল…দেখলাম সেই ভয়াবহ বৃদ্ধ লোকটার কাটামুন্ডুটা..চোখদুটো যেন জ্বলছে..আমার ঠিক মুখের সামনেই হাওয়ায় সেটা যেন ভাসছে..স্পষ্ট শুনলাম গম্ভীর গলায় সে বলল, “আমায় একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও না ডাক্তার..তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি..!!”
আর কিছু মনে নেই……!!!!!!!!
…….শীতকালের কোনও এক সন্ধ্যেয়, নদীর ধারের বিরাট জমিদারবাড়ীটার সামনে আমার রিকশা থেকে নামল এক সুবেশ ভদ্রলোক। ভাড়া নেওয়ার সময় দেখলাম সে যেন বেশ একটু অবাক হয়েই তাকালো আমার মুখের দিকে। ভাড়া মেটাবার পর জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা দাদা, এখান থেকে ফেরার সময় রিস্কা, ভ্যান ট্যান এসব পাবো তো? মানে অনেকদূর ফিরবো তো ট্রেন ধরে, তাই!” আমিও চোস্ত জবাব দিলাম, “না বাবু, এদ্দূরে কেউ সাঁঝের পর আর আসতে চায় নে। তবে আপনে বইললে মু ঘন্টাখানিক থাকব আজ্ঞে। আপনারে ইস্টিশনে নে ছাড়ে দিব!!” লোকটা দেখলাম আমার কথায় বেশ খুশি হয়ে মাথা নেড়ে একটা সিগারেট ধরাল, তারপর শিস দিতে দিতে জমিদারবাড়ীর ভাঙা সিংহদরজাটার একদিকের পাল্লাটা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল। আমি গলার মাফলারটা ভালো করে মাথা দিয়ে জড়িয়ে চোখদুটো বুজে যথারীতি ঢুলতে শুরু করলাম!
হাতে অনেকটাই সময় আছে, লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে ফেরা অবধি বেশ একচোট ঘুমিয়ে নিতে পারব এখন…!!!