ফেরা না ফেরা_Sankar Bramha

0
0
Share:

ফেরা না ফেরা

শংকর ব্রহ্ম

—————————————-

(এক).

           চদ্রনাথ রায় সারা জীবন ধরে একটি বৃক্ষ খুঁজে চলেছেন। যার শীতল ছায়ায় শুয়ে বসে, আনমনা হয়ে, কেবল কবিতা লিখে যাবে মন-প্রাণ দিয়ে, সারা জীবন ধরে। মনে মনে সত্যিই কবিতাকে খুব ভালবাসত, সে তাই চেয়েছিল কবিতাকে নিয়ে সারা জীন থাকতে। অনেক কবিতাই সে লিখেছিল তার মধ্যে সবগুলােই যে কবিতা হয়ে ওঠেনি, তা সে নিজেই বুঝতে পারত , এমন কি লেখার সময়ও, তবুও সে লিখে যেত প্রাণের আবেগে। কবিতা লিখতে তার কতই না ভাল লাগত, আনন্দ হত। এই জীবনটাই তার ভালাে লাগত। মান সম্ভ্রমের তেমন কোন আলগা বালাই নেই, তেমন কোন গুরু-দায়িত্ব নেই, থাকার মধ্যে আছে এক নির্ভেজাল দারিদ্র। ছেঁড়া চটি পায়ে, যে কোনও একটা জামা গায়ে, সেটা জীর্ণ পুরণো হােক তাতে কোন ক্ষতি নেই। তারপর একটি গাছের তলায় শুয়ে বসে কেবল কবিতা লেখা। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে জীবনে, সে ভাবত মনে মনে ?

    বসিরহাট মাধ্যমিক স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে চন্দ্রনাথ প্রথম কলকাতায় মামার বাড়িতে

থেকে পড়তে এসেছিল। প্রয়ােজনীয় বই-পত্তর পড়াশােনা  তার পড়তে ভালাে লাগত না তেমন, যত ভাল লাগত নতুন কবিদের লেখা কবিতার বই, সদ্য প্রকাশিত কবিতা পত্রিকা পড়তে। ফলে

কোনও মতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেও, কলেজে পড়া আর হয়ে ওঠেনি তার।

তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। সে এখন একজন সফল সাংবাদিক।

  সাংবাদিকতার বিষয়ে তার বইও বেরিয়েছে, নাম করেছে সেই বই । কিন্তু কবিতার কোনও বই বের হয়নি আজও তার। এটাই মনে দুঃখ তার।

    তিনি তার মনের একান্ত বাসনার কথা সেদিন আমার কাছে বলেছিলেন। আমরা একটা বারে বসে মদ্যপান করছিলাম। মনের গােপন বাসনার কথা বলে সে তৃপ্তি বােধ করেছিল। কবির অলস জীবন-যাপন, স্বাধীন- চলা ফেরা,তার রােমাঞ্চকর মনোবাসনার কথা যারা শুনতে চায় তাদের কাছে বলে সে হালকা বোধ করত। যারা শুনতে চাইতো না, তাদের কাছে বলেও।

বলেও সে স্বস্তি বােধ করত। কেউ কেউ বিরক্ত হতো ঠিকই। তাতে কিছু আসত যেত না তার। বলাটাই যেন তার কাজ। কেউ শুনুক আর না শুনুক।

  সাংবাদিক চন্দ্রনাথ রায়, চাঁদু দা নামেই সকলের কাছে পরিচিত। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, আমার স্ত্রী স্নিগ্ধা যেদিন আমাকে লাথি তাড়িয়ে দিয়েছিল, সে’দিনটা ছিল আমার জীবনে সত্যিই একটা শুভদিন। কী এক অব্যক্ত যাতনায়, তীব্র আক্রোশে সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। 

             সেদিন একটি কবিতা লিখেছিলাম –

‘দুপুর রােদের মাঠ পেরোলেই বন্ধু পাবে

প্রিয় সাথীর সঙ্গে তোমার দেখা হবে

সে-ই তোমায় পৌঁছে যাবে বার-দুয়ারী 

বার-দুয়ারী পৌঁছে গেলেই মনের ভিতর গড়ের মাঠ

তুমিই তখন হাসতে হাসতে গড়ের বিশাল মাঠ পেরোবে

প্রিয় নারীর সঙ্গে তােমার দেখা হবে শেষ বিকেলে, 

রোদের নিকেল ফুরিয়ে গেলে

তুমিই তখন খেলার ছলে প্রেম শেখাবে প্রেমিকাকে

হঠাৎ আবেগ, তীব্র বেগে বুকের ভিতর টানবে তাকে।

বার দুয়ারী, প্রিয় নারী এসব ভাল

তার চেয়েও আরও ভাল দুপুর রােদের নিকেল আলাে,

সবার চেয়ে বেশী ভাল-

দুপুর রােদের মাঠ পেরনাে প্রিয় তােমার বন্ধুগুলো।’

          কবিতা শুনে বন্ধুদের অনেকেই সমাদর করেছিল। ফলে মনে একটা চাপা আনন্দ

প্রবাহ তৈরী হয়েছিল। সেই আনন্দ প্রবাহ মনে ধরে নিয়েই, আনন্দে বাড়ি ফিরে এসে আমি স্নিগ্ধাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে, কবিতাটা শোনাতে চেয়েছিলাম। ঠিক তখনই ও জলন্ত দৃষ্টিতে আমাকে পুড়িয়ে হাই করে দিতে চেয়েছিল। 

“তীক্ষ্ণ শব্দ-বাণের”বেগে আমাকে ঘায়েল করে, বুকে নুড়োর জ্বালা জ্বেলে আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। তার ধাক্কায় বুকের পাঁজরে তীব্র খোঁচা লেগে, ব্যথায় অবশ করে উঠেছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম মনে, মনের গভীরে। মনে হয়েছিল, স্নিগ্ধা আমাকে সেদিন বেওয়ারিশ কুকুরের মতাে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন। 

আজ মনেহয় সেদিন হয়তো সে আমাকে উচিৎ শিক্ষাই দিয়েছিল। তা’তে আমার সম্বিৎ ফিরে এসেছিল। যেন দীর্ঘ ঘুমের পর হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে ,জাগড়ণের পর যেন অপার বিস্ময়ে ,  অকস্মাৎ এই আঘাতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। হ্যাঁ সত্যিই নিজেকে খুজে পেয়েছিলাম সে’দিন, সম্পূর্ণ একা নিঃসঙ্গ। 

       সিন্ধার ফেলে যাওয়া সংসারে বিমুঢ় হয়ে, নির্বাক সারা রাত সােফায় বসে কাটিয়ে দিয়েছিলাম শুধু। বিশেষ কিছুই ভাবিনি। তবে দৃঢ় সংকল্প করে ফেলেছিলাম, আর কবিতা নিয়ে মেতে থাকা চলবে না। এক প্যাকেট সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল সে রাতে।

    একদিন ভেবেছিলাম , রবীন্দ্রনাথ না হতে পারি কবি প্ৰাণনাথ হতে বাধা কোথায়? সেদিন সে আশা নির্মমভাবে, চিরতরে জলাঞ্জলি দিয়ে মন স্থির করে ফেললাম, এবার থেকে এমন কিছু করতে হবে যাতে রুটি রুজির ব্যবস্থা হয়।

ভােরের আলাে চোখে পড়ায় সম্বিৎ ফিরে এলো। বলা যায় ঠিক ওই দিন থেকেই সাংবাদিকতাকে

জীবিকা হিসাবে ধরে, তাকে ভর করে উঠে  দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। সেদিন কেন সাংবাদিক হব ভেবেছিলাম, তা আজ আর ঠিক মনে নেই। হয়তো ভেবেছিলাম, ‘সাংবাদিকতা’ কাজটির গালভরা নাম স্নিগ্ধাকে কিছুটা স্বস্তি দেবে মনে।

        হ্যাঁ, যা ঘটবার তা মানুষের জীবনে হঠাৎ করেই ঘটে যায়,পিছনে তার কার্য কারণ আর যা-ই থাকুক।

         সিগ্ধা আমাকে অপদার্থ, নিষ্কর্মার টেকি, মুরােদ নেই কোন কাজের, কত কিছুই বলেছে। কিন্তু সেদিনের মতো এমনভাবে কোনওদিনই ও কথাগুলাের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারিনি।

স্নিগ্ধা একটা হাইস্কুলে পড়াত, শিক্ষা-দীক্ষা রুচিতে আমার চেয়ে হয়তাে উঁচুতে ছিল। ফলে, আমার ভিতর একটা হীনমন্যতা কাজ করত সব সময়। বলে গ্লাস শেষ করলেন চাঁদু-দা।

(দুই).

        বিশ বছর কবিতা লিখে কিছুটা নামডাক হয়েছে আমার। কয়েকখানা বই বেরিয়েছে, কলেজ-স্ট্রীটের প্রকাশনী থেকে। পুরস্কার-টুরস্কার জুটেছে দু-একটা। সরকারি বে-

সরকারি অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের ডাক পাই। তাই আজকাল বার দুয়ারী বা খালাসীটোলার বাংলা মদের ঠেকে যেতে রুচিতে বাধে। ও সব জায়গায় সস্তায় লোকেরা মদ খেতে যায়। চ্যাংড়া ছােকড়াদের হৈ হট্টোগোল মাতামাতি লেগেই থাকে।

 আজকাল ট্রিংকাস বা ব্লু ফক্সে যাই আমি ড্রিংঙ্ক করতে (মদ খেতে নয়)। সেখানেই চাঁদুদার সঙ্গে দেখা। তার সঙ্গে কবে কোথায় পরিচয় হয়েছিল ঠিক মনে নেই। তবে কোনও অনুষ্ঠানেই সম্ভবতঃ আলাপ হয়ে থাকতে পারে মনেহয়।

    তিনি ছিলেন সকলেরই চাঁদুদা। আমিও তাই বলে ডাকতাম।

(তিন).

চাঁদুদা বললেন, আর এক পাত্র করে হুইস্কি হয়ে যাক। কি বলেন?

আমি সায় দিয়ে বললাম, তা, বেশ তাে, আপত্তি কিসের ?

        চাঁদুদা বয়কে ডেকে দু-পেগ হুইস্কির অর্ডার দিলেন। তারপর নড়েচড়ে একটু সােজা হয়ে বসলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, স্নিগ্ধার শিক্ষাদীক্ষা রুচি কোনওটাই ওর কিছু ফেলনা ছিল না। ও এমনিতে হাসি খুশি মধুর স্বভাবের ছিল। কিন্তু, ওর সেই রসবােধ ওর জীবনে সত্যিকারের কোনও কাজে লাগেনি। অপ্রীতিকর পরিস্থিতির হাত থেকে ওকে নিস্তার দিয়ে, পেতে পথ দেখাতে পারেনি। পােশাকের অতিরিক্ত ঝালরের মতাে শুধু শােভাই বাড়িয়েছে, প্রয়ােজনের সময় কোনও কাজেই লাগেনি।

      স্নিগ্ধা যে খুব বেশি সুন্দরী ছিল তা নয়। তবে তার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, যা আমাকে খুব আকর্ষণ করত। এক-এক সময় তার বিভিন্ন ভঙ্গি আর মনের বিশেষ অবস্থায় দিকে তাকালে, বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠত আমার। কবি সত্তা জেগে উঠত মনে। সে সময় অতি সাধারণ তুচ্ছ ঘটনাও আকর্ষণীয় হয়ে উঠত আমার চোখে।

       তবে, একসঙ্গে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বাস করা সােজা কথা নয়। এতে সঙ্গীর মন্দ দিকটা বেশী করে প্রকট হয়ে পড়ে। ভাল দিকগুলাে হারিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। তিন বছর এক সঙ্গে কেটেছে আমাদের। আজও মাঝে মাঝে হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠলে, তীব্র আক্রোশে, আর রাগে মনে হয়, কেন ওকে বিয়ে করে জীবনের মূল্যবান তিনটি বছর এমনভাবে নষ্ট করলাম। সবটাই অপচয় হয়েছে আমার জীবনের।

    সত্যিই ও খুব শক্ত ধাঁচের মেয়ে ছিল। নারীর সুলভ সহজাত মাধুর্য ওর মধ্যে কিছুই ছিল না। সে মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দিত, আমি যদি পঙ্গু হতাম, তা হলে ও আমার ভরণ পোষণ আনন্দে বহন করতো। আমার জন্য কাজ করে খাওয়াতো , আমার সেবা যত্ন করত। কিন্তু যে আমি সুস্থ সবল হয়েও চাকরির কোনও খোঁজ করি না, তার জন্য ও কিছুই করতে পারবে না,পারলেও করবে না। ও আমাকে সবসময় বলত, অপদার্থ, নিষ্কর্মার-টেকি। ওর জীবন আমিই ব্যর্থ করে দিয়েছি ! আরও কত সব শক্ত শক্ত হুঁল ফোটানাে কথা,  ‘বিষ-মাখা ধাঁরালো’ তীরের মতাে।

ওর ধারণায় অসভ্য বর্বর কতগুলো লােক – আমার বন্ধু হিসাবে আমার বাড়িতে আসত।

নিয়মিত যাতায়াত করত তা’রা।  তা ও মোটেই পছন্দ করত না। সহ্য করতে পারত না ওদের। আমি ওকে বােঝাবার চেষ্টা করলাম, এরা কেউ শিল্পী, কেউ কবি! ও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিল, ও একদম ওদের বরদাস্ত করবে না।

আমি বলতাম, ওরা সব প্রতিভাবান, স্রষ্টা। 

স্নিগ্ধা তা শুনে বিদ্রুপ ব্যঙ্গ করে বলতো, ছাড়ো তাে ওসব হেঁদো কথা। এ’সব নিয়ে প্রায়ই ওর সঙ্গে সঙ্গে তর্ক বিতর্ক হতো আমার । ও শ্লেষের সুরে বলতো,

– আহা রে  কী আমার কবি? ও কেন পােশাক বদলায় না? রোজ দেখি একই পোষাক পরে আসে। স্নিগ্ধা প্রশ্ন ছুঁড়তাে আমার কাছে।

আমি বলতাম, হয়তাে ওর আর কোন পোশাক নেই।

– শিল্পী কেন এত পেটুক, খাবারের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো।

আমি বলতাম, হয়তাে পেট ভরে খেতে পায় না ঘরে।

স্নিগ্ধ কিছুতেই সেটা মানতে চাইলে না। 

কেবলই একই প্রশ্ন করে চলতো , তবে কেন ওরা যে কোন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে না। খেতে না পেয়ে , মরে গেলে শিল্প দিয়ে কি হবে ওদের?

শিল্পীর জীবনে দারিদ্র যে নিত্যসঙ্গী সে কথা

 ওকে কিছুতেই বােঝানাে যেত না। ও তা মানতে চাইতো না।

ও বলত, তা হলে আমি বলতে পারি, এ দারিদ্র, শখের দারিদ্র। সাধ করে দারিদ্র ভোগ করা।

        তাই আমার বন্ধু শিল্পী কবিদের দু’চোখে দেখতে পারত না স্নিগ্ধা। ওকে আমি বােঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, এই সব শিল্পী কবিরা জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দের তােয়াক্কা না করে, হৃদয়ের আর্তির  কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। মনের চাহিদাটাকেই বড় করে দেখে। আর চিরজীবনের জন্য দুঃখ-কষ্ট-দারিদ্র স্বেচ্ছায় তা মেনে নেয় মনের আনন্দে।

স্নিগ্ধা শুনে বলত, ” ফুঃ। যত সব বাজে কথা।

ওরা শুধু বড় কোন সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তোমার  মতো কেউ বোকা নয় ওরা , সে আমি ভাল করেই জানি।”

         ও ঠিক কথা বলেছিল। ওর কথাগুলি প্রকাশ্য দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল কিছু দিনের মধ্যেই।

       শিল্পী এক ধনী বিধবাকে বিয়ে করে, বিদেশে পাড়ি দিল তার ছবির প্রদর্শনী করতে। 

      কবি সরকারি একটা চাকরী পেয়ে কবিতা লেখা ভুলে গেল। এখন আর কবিতা লেখে না। বেশ সাচ্ছন্দে আছে জীবনে। শুনেছি, এক ধনীর মেয়েকে বিয়েও করেছে সম্প্রতি। ঘোরতর সংসারী সে এখন। কবিতা লেখার সময় হয় না আর তার।

          বেয়ারা দু’পেগ হুইস্কি  আমাদের গ্লাসে ঢেলে দিয়ে গেল। সোডা মিশিয়ে চাঁদু-দা ছােট্ট চুমুক দিলেন, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘বিযের পর প্রথম প্রথম স্নিগ্ধা মুখে কিছুই বলত না। কিন্তু দিনের পর দিন কিছু কিছু ব্যাপারে সে অখুশী হতে শুরু করল। প্রথম কয়েক সপ্তাহ তাে মাঝে মাঝেই কাঁদত। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতে পেতাম, নিরুপায় কান্নায় আকুল হয়ে উঠেছে সে।

সকালে উঠে বসে চা খেতে খেতে, মাঝে মাঝে হাতে মাথা রাখে, কাঁদতে শুরু করত।

আমি প্রশ্ন করে তার কারণ জানতে চাইলে ও শুধু বলতো, ও কিছু না। আমার কি হয়েছে ছাই, আমিও কি বুঝি নাকি? শুধু কান্না পায়, তাই কাঁদি। ওর এ’রকম মনােভাব অবশ্য বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু তা’তে স্বপ্ন-ভরা রাতগুলি আমাদের বিষিয়ে গেল।

         স্নিগ্ধার , ও রকম অদ্ভুত আচরণের এখন অবশ্য আমি কারণ বুঝি। ও আমার বন্ধুদের

এক পছন্দ করত না। ধীরে ধীরে আমিও অসহ্য হয়ে উঠলাম ওর কাছে। মনের  মতো করে ওকে আমার গড়ে তোলার  আর কোন উপায়ই রইল না।

         বিয়ের আগে আমি কত স্বপ্ন দেখেছিলাম।

মনের মতােন করে ওকে গড়ে তুলব। তার আর কোনও উপায় রইল না। বিয়ের আগে আমি ভেবেছিলাম ওর নিরাপদ ছায়ায় আমার কাব্যচর্চা ব্যপ্তি পাবে। প্রসারিত হবে বৃক্ষের ডাল-পালার মতো। তা আর হয়ে উঠল না।

সারা জীবন ধরে আমি একটা গাছ খুঁজেছিলাম। যার শীতল ছায়ায় আনমনে শুয়ে বসে নিজের মনে কেবল কবিতা লিখে কাটিয়ে দেব। স্নিগ্ধাকেও কী সে’রকম কোন গাছ ভেবেছিলাম আমি? হয়তো তাই ভেবেছিলাম। জানি না ঠিক।

     স্নিগ্ধা চলে গিয়ে, না জেনে বুঝেই বড় উপকার করে গেছে আমার। অবশ্য ভেঙে  চুরমার করে দিয়ে গেছে আমার কবি হবার স্বপ্ন। যা’র হওয়ার কথা ছিল কিনা , এ যুগের এক বিশিষ্ট কৰি।   

       আজ সে হয়ে গেল একজন সাংবাদিক মাত্র।

   কাপুরুষের মতো একটা ভীতি সর্বদাই আমার মন জুড়ে ছিল, এই বিবাহ বুঝি অচ্ছেদ্য বন্ধন। পরিণামে যতি খারাপই হোক, যতই তিক্ততাই আসুক, যতই নিষ্ঠুরতাই থাকুক, সব সহ্য করতে হবে আমাকে। তবু যেন নির্বিকারভাবে, একজনের আর একজনকে ভালােবাসতে হবে আমরণ । 

শেষ দিকে আমারও ওকে অসহ্য মনে হতাে। ওর

কাছে সত্যিই আজ খুব কৃতজ্ঞ আমি,ও আমায় ছেড়ে না চলে গেলে , হয়তাে ভবঘুরে হয়েই থাকতাম সারাটা জীবন। কবিতা লিখবার চেষ্টা করে সময় নষ্ট করতাম।

    শহরের সস্তা চায়ের দোকালে কিংবা রবিবার সূতৃপ্তিতে বসে বক্তৃতা করতাম বাস্তবাগীস , চতুর, দারিদ্রলাঞ্ছিত শিল্পী কবিদের সঙ্গে আড্ডা মারতাম! যারা কিছু একটা নতুন সৃষ্টি করার আগ্রহে সমানে বকবক করেই চলেছে। এখনও ভাবি এরা সব সত্যিকারের কবি-শিল্পী একটুও ভেজাল নেই এঁদের মধ্যে। এঁরা কখনোই

নিজেদের বিকিয়ে দেয় না, এঁরা নিষ্কর্মা’ও  নয়। শিল্পের সাধনায় অবিরত শ্রম করে চলেছে। জাত শিল্পী সব।

        আমি বললাম নির্ভেজাল পবিত্র শিল্প।

আহা আমাদের গ্লাস আবার শূন্য হয়ে গেল যে।

চাঁদু দা বললেন।

আবার হুইস্কি এল। গ্লাস ভরে উঠল। চাঁদুদা গ্লাসে একটা ছােট চুমুক দিয়ে, আবার আবার বলতে শুরু করলেন,

      যে গাছের তলায় শুয়ে থাকার কল্পনা করেছি, স্বপ্ন দেখেছি, সে গাছটি আর খুঁজে

পেলাম না সারা জীবনে।

কাজে আর ভাবনায় কবি হওয়ার সাধনা আর কামনা নিয়েই এতদিন ছিলাম। সে স্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে চলে গেল স্নিগ্ধা । কবি হওয়া আর হল না আমার । 

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো চাঁদুদার।

হলাম দৈনিক পত্রিকার ব্যস্তু সাংবাদিক। শুয়ে বসে কাটানাের অলস জীবন কোথায় হারিয়ে গেল? শেষে আপসোসের সুরে বললেন, আপনাদের মতাে কবিদের দেখলে, হিংসা হয় মশায়।

চাঁদুদা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমি দেখলাম, চোখদু’টি তার কিছুটা

লাল আর দৃষ্টি ঘােলাটে। আমারও বেশ নেশা হয়ে গেছে।

– রাত কত্ত হল চাঁদু-দা? আমি জানতে চইলাম।

“ ওহ্ , আপনার তো আবার বাড়ি-ঘর, ,ছেলে ৰউ আছে। তাহলে চলুন ওঠা যাক। রাত কম হয়নি? বেয়ারকে ডেকে তাকে বিল মিটিয়ে দিলেন। আমিও কিছু দিতে চাইলাম। দিতে দিলেন না।

বেরিয়ে এসে রাস্তায় একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। চাঁদুদা জোর করে আমায় তা’তে তুলে দিয়ে বললেন,আপনি আগে যান কবি।

         বৌদি হয়তো আপনার ফেরার অপেক্ষায় বসে আছেন। আমি তো আজও ভুবঘুরেই রয়ে গেছি মনে মনে। কাজের সময় যত ব্যস্ততাই থাক, অন্য সময় আমার মতো নিষ্কর্মা আর খুব একটা বেশী পাবেন না ।

হা হা হা হা করে চাঁদু-দা মাতাল স্বরে হাসলেন।

– চলি, বলে আমি ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। ট্যাক্সি চলতে শুরু করলাে। দেখলাম, দূরে দাঁড়িয়ে চাঁদু-দা হাত নাড়ছেন। যেন সে নিজেই একটা গাছ হয়ে, ডাক পালা ছড়িয়ে, অন্যকে ছায়া বিলােবার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।

(চার).

          এরপর বহুদিন চাঁদুদা’র সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। প্রায় সাত আট মাস বাদে বইমেলায় হঠাৎ, দেখা হয়ে গেল , তার সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেজিয়ানে।

          বেশ খুশ মেজাজে আছেন দেখলম।

আমি বললাম, কি ব্যাপার চাঁদুদা, এতদিন দেখিনি কেন আপনাকে? বাইরে কোথায়ও গেছিলেন নাকি সাংবাদিকতার কাজের প্রযোজনে?। 

– উত্তর-বঙ্গে গেছিলাম।

– কেন, কোন কাজ?

– হ্যাঁ, মানে না, তেমন কোন কাজ নয়। আবার জরুরী কাজও বটে।

 চাঁদু-দা রহস্যময় ভাবে হাসলেন।

– মানে?  রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি একটা।একটু খুলে বলুন না, ব্যাপারটা..

– হ্যাঁ বলব,চলো আগে একটা কোন চা – কপির স্টলে গিয়ে বসি।

আমি বললাম, বেশ তাই চলুন তবে। 

ঘুরে ঘুরে বসার মতো একটা ফাঁকা স্টল খুঁজে পেলাম না। চাঁদু দা হেসে বললেন, এরা কি বই কিনতে আসে নাকি খেতেই আসে শুধু?

– আমি বললাম,কি জানি?

আমরা দোকান থেকে দু’কাপ কফি কিনে নিয়ে, মাঠে এসে পা ছড়িয়ে বসলাম।

ধোঁয়া-ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিয়ে চাঁদু-দা বললেন, 

– স্নিগ্ধার কাছে গেছিলাম, ও ডেকেছিল। একবার দেখা করার জন্য বলেছিল। তাই

ওখানেই…

– বেশ সুসংবাদ তো। এরপর কি হল বলুন ?

      সেদিন বারে হুইস্কি খেতে খেতে স্নিগ্ধার সঙ্গে বিচ্ছেদের কাহিনি শুনেছিলাম, তখন

কল্পনাও করতে পারিনি, কিছুদিন বাদে বইমেলার মাঠে বসে কফি খেতে খেতে তাদের

মিলনের কাহিনী শুনব।

       চাঁদুদা মুচকি হেসে বললেন, জানেন কবি,

জীবনে যা ঘটবার তা আমকাই ঘটে যায়। স্নিগ্ধা কোনওদিন আবার ফিরে আসবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবতেই পারিনি। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর, ওর লেখা একখান পােস্টকার্ড পেয়ে অবাক

হয়ে গেছিলাম। ওর বাপের বাড়ি ময়নাগুড়ি থেকে লেখা। বেশি কিছু লেখা ছিল না তাতে। একবার দেখা করার অনুনয় শুধু। তার বেশি কিছু নয়। ভেবেছিলাম, যাব না।

    যাব না ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত না গিয়ে থাকতে পারিনি কি। এক অপার কৌতূহল, আমাকে যেতে বাধ্য করেছিল। ভাবলাম, কি জন্য ডেকেছে স্নিগ্ধা ? পাঁচ বছরের মধ্যে একবারও তো এরকমভাবে কখনো চিঠি লেখেনি সে ? তবে কি ওর কোন বিপদ ? নাকি অসুস্থ সে? যাই একবার গিয়ে দেখে আসি। একসঙ্গে দুঃখে সুখে তিনটে বছর তাে কেটেছিল আমাদের।

যাই একবার দেখা করে আসি ভেবে, চিঠি পাওয়ার দু’দিন পর দিন রওনা দিলাম। এই দু’দিন যাব কি যাব না-এই করে দ্বন্দ্বে কোটছে আমার।

গিয়ে দেখলাম স্নিগ্ধা সুস্থই আছে, আমাকে দেখে সাদরে আপ্যায়ন করল।

নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসলো। শুনলাম, ওর বাবা মারা গেছেন। তারপর

থেকেই দাদা তার উপর মানসিক অত্যাচার শুরু করেছে। এখান থেকে তাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো স্নিগ্ধা। এরপর ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলতে লাগল , আমি এখন ভীষণ একা একটু থেমে আরও বলল, সবকিছু ভেবেচিন্তে আমি এখন বুঝেছি আগের অনেক হাঙ্গামার জন্য আমি নিজেই দায়ী।

   তোমার সঙ্গে আগের সে’সব দুর্ব্যবহারের জন্য আমি এখন অনুতপ্ত। আমি এখনও তোমাকে ভালবাসি। আগেও বাসতাম।

তোমার কবিতা পড়ে, তোমার সঙ্গে আমিই তো প্রথম সেধে পরিচয় করেছিলাম। বিয়ের আগে তােমার সঙ্গে মিশে তােমাকে ভালােবেসেছিলাম। বেকার হওয়া সত্ত্বেও তোমাকে, বাড়ির সকলের অমতে, বিয়ে করেছিলাম। এ’সব তাে মিথ্যে নয়, তা তুমিও জান। আর তাই আজ বুঝেছি তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ। আমি আবার তােমার কাছে ফিরে যেতে চাই।

      স্নিগ্ধা চলে যাবার পর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর কোনও দিন ও ফিরে আসতে

চাইলেও আমি কিছুতেই রাজি হব না। কিন্তু ওর চোখের জলের অসহায় ধারা, সে প্রতিজ্ঞ আমারভাসিয়ে নিয়ে গেল কোথায়।

স্নিগ্না আরও বলল, আমরা দুজনে মিলে সুখের সংসার আজও গড়ে তুলতে পারি, সে বিশ্বাস আমার এখনও আছে। চলে আসার পর তােমার সব লেখাই আমি খুঁজে খুঁজে পড়েছি। তােমার বইখানাও পড়ে ভালাে লেগেছে। কিনে ঘরে রেখেছি।  সময় পেলেই মাঝে মাঝে আমি তা পড়ি। আমি এখন বুঝেছি, তুমি নিষ্কর্মা বা অপদার্থ নয় মোটেও।

চাঁদুদার কথা শুনতে শুনতে কখন কফির কাপ শেষ হয়ে গেছে।

চাঁদু দা বললেন, কফি আর এক কাপ করে হয়ে যাক ।

আমি আপত্তি করে বললাম, না থাক । আপনি খেলে নিন আর এক কাপ।

চাঁদুদা বললেন, না তবে থাক।

আমি বললাম, তারপর ?

চাদুঁ দা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তারপর আর কি? সঙ্গে করে নিয়ে ফিরলাম স্নিগ্ধাকে।

এখন তাহলে আপনার কাছেই আছে সে ?

চাঁদু দা যেন শুনতে পাননি আমার প্রশ্ন। আমার সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে উনি বললেন, শেষপর্যন্ত স্নিগ্ধা তাে ফরলাে কিন্তু আমার কবিতা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেল। সে আর ফিরে এলো না আমার কাছে।

– একটি গাছের অভাবে? আমি বললাম।

গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চাঁদুদা নিঃশব্দে করুণ হাসলেন।

user

Writer & Blogger

Related Posts:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Popular Posts

Newsletter

JOIN THE FAMILY!

You have been successfully Subscribed! Please Connect to Mailchimp first

Featured Posts

Categories

Edit Template

Dhulobali, a platform for collaborative creativity. It empowers users to share ideas and innovate together in cultural arena.

Get In Touch

3540 Toringdon Way Suite 200 Charlotte, NC, US 28277