আমি মৃণালিনী সেন,
কিন্তু পাড়ায় সবাই চেনে খোকার মা বলে।
এতএত বছর আমি নিজের পরিচয় ভুলেই গিয়েছিলাম,
শুধু “খোকার মা”আমি এটা মনে রাখতাম।
জানো আমার খোকা সময়ের আগে জন্মেছিল,
“এ ছেলে বাঁচবে না”ডাক্তার বলে দিয়েছিল।
আমি পণ নিয়েছিলাম খোকাকে আমি বাঁচাবো।
খুব তো পয়সা ছিল না আমাদের,
তার উপর জাঁকিয়ে বসেছিল অভাব ও।
ধার করে দুধ আনতাম আমার খোকার জন্য,
আরো কতকিছু যাতে আমার কোল না হয় শূন্য।
বেশি দিন এভাবে চলল না,
দেনা করতে করতে একদিন সব চলে গেল,
আশ্রয়টুকুও আর থাকলো না।
আমাদের ঠিকানা হলো রেলের বস্তিতে,
কিন্তু জানিস খোকা,
তোকে সঙ্গে নিয়ে থাকতাম খুব স্বস্তিতে।
আস্তে আস্তে তুই বড় হলি,
প্রাণটা জুড়িয়ে যেত শুনে তোর মুখে আধো বুলি।
ছোট থেকেই তোর পড়ার প্রতি খুব টান,
মনে আছে খোকা তুই বলতিস,
আমি বাড়াবো তোমাদের মান।
রাতে যখন ট্রেনের শব্দে ভয়ে উঠতিস কেঁদে,
আমি দুই হাতে তোকে বুকের মধ্যে নিতাম বেঁধে।
তুই বলতিস “মা” বড় হয়ে
আমি তোমায় নতুন বাড়ি দেবো,
তুমি,আমি,বাবা একসঙ্গে সেখানে থাকবো।
দেখতে দেখতে মাধ্যমিক দিলি,উচ্চমাধ্যমিক দিলি,
সেখানে ভালো নম্বর পেয়ে
স্কলারশিপের টাকায় কলেজে ভর্তি হলি।
তার কিছুদিন পর তোর বাবা গেল চলে,
তুই তখন আমার একমাত্র আশা হোলি।
বিয়ে করলি নিজের পছন্দমত,
আমাকে জানালে খুব কি ক্ষতি হতো।
একদিন এলি ঠিক-ই আমার এই ছোট্ট ঘরে,
তবে তোর সব জিনিস নিয়ে যাবার তরে।
বললি,”তোমার জন্য নতুন ঘর ঠিক করেছি
চলো তোমাকে সেখানে রেখে আসি”।
ভাবলাম তুই নিয়ে যাবি তোর আর বৌমার কাছে,
কিন্তু একি!এখানে তো দেখছি বৃদ্ধাশ্রম লেখা আছে!
খোকা,তোকে বড় করার দাম এভাবে দিলি,
আমাকে এতটাই পর ভেবে নিলি।
আজ বারো বছর হলো তোকে দেখিনা,
তোর মা-কে একটুও মনে পরেনা?
আয় না খোকা একবার তোর মায়ের কাছে,
দুচোখ ভরে দেখবো যতদিন দেহে প্রাণ আছে।
তুই না খেয়ে দৌড়বি সারা ঘরময়,
বিশ্বাস কর খোকা তোকে কাছে পেতে বড্ড ইচ্ছা হয়।
শুনেছি তোর ছেলে হয়েছে,কি নাম দিলি?
তাকে তার ঠাম্মার কথা কক্ষনো বলেছিলি?
তোর ফ্ল্যাটে আমার কোন ছবি আছে?
খোকা,তোর বৃদ্ধ মায়ের কোনো স্মৃতি মনে আছে!
আমি এখানকার সবাইকে বলেছি,
তুই একজন ডাক্তার,
ওরাও তোকে দেখতে চেয়েছে একটি বার।
জানিস আজ আমি বিছানায়,বুকে খুব ব্যথা,
এখানকার সবাই ভেবেছিলো
তোকে জানাবে আমার কথা।
আমার খোকা একজন ডাক্তার,তবু হায়!
আজ আমি মরতে চলেছি বিনা চিকিৎসায়।
আমি ওদের বলেছি
আমি মারা গেলে তোকে যেন খবর দেয়,
তুই তখন একটু আসিস যে কোনো বাহানায়।
চিরকাল তুই থাকবি আমার হৃদয়ে,
আর আমি বাঁচবো আমার “খোকার মা” হয়ে।
ইতি-খোকার মা